চট্টগ্রাম জেলার নদ-নদীসমূহঃ
১। কর্ণফুলি নদী
কর্ণফুলী নদীবাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি প্রধান নদী। এটিভারতেরমিজোরামেরলুসাই পাহাড়ে শুরু হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মধ্য দিয়েপ্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রামেরপতেঙ্গার কাছে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এই নদীরমোহনাতে বাংলাদেশের প্রধান সমূদ্র বন্দরচট্টগ্রাম বন্দরঅবস্থিত। এই নদীরদৈর্ঘ্য ৩২০ কিলোমিটার।
নামের ইতিকথা
কর্ণফুলীনদীর নামের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন কাহিনী প্রচলিত আছে। কথিত আছেযে, আরাকানের এক রাজকন্যা চট্টগ্রামের এক আদিবাসী রাজপুত্রের প্রেমেপড়েন। একজ্যোৎস্নাস্নাত রাতে তাঁরা দুই জন এই নদীতে নৌভ্রমণ উপভোগকরছিলেন। নদীরপানিতে চাঁদের প্রতিফলন দেখার সময় রাজকন্যার কানে গোঁজাএকটি ফুল পানিতেপড়ে যায়। ফুলটি হারিয়ে কাতর রাজকন্যা সেটা উদ্ধারেরজন্য পানিতে ঝাঁপিয়েপড়েন। কিন্তু প্রবল স্রোতে রাজকন্যা ভেসে যান, তাঁরআর খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাজপুত্র রাজকন্যাকে বাঁচাতে পানিতে লাফ দেন, কিন্তু সফল হন নি।রাজকন্যার শোকে রাজপুত্র পানিতে ডুবে আত্মাহুতি দেন। এইকরুণ কাহিনী থেকেইনদীটির নাম হয় 'কর্ণফুলী।মার্মা আদিবাসীদের কাছে নদীটির নাম কান্সা খিওং।
কর্ণফুলী নদীর চর
১৮৮৩সালে কর্ণফুলীর মোহনায় সৃষ্টি হয় লুকিয়া চর। ১৮৭৭ সালেজুলদিয়াচ্যানেল। জুলদিয়া চ্যানেলটি আড়াই মাইল দীর্ঘ এবং দেড় মাইলপ্রশস্ত।১৯০১ সাল থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে পতেঙ্গা চ্যানেলটি জুলদিয়াচ্যানেল থেকেপ্রায় দেড় হাজার ফুট পশ্চিমে সরে যায়। হালদা নদীর সাথেকর্ণফুলীর সংযোগস্থলে আছে বিশাল চর। যা হালদা চর হিসাবে পরিচিত। নদীরপ্রবাহের কিছু অংশনাজিরচর ঘেঁষে, কিছু অংশ বালু চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে এবংকিছু মুল স্রোতহিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে। ১৯৩০ সালে কালুরঘাট রেলওয়ে সেতুনির্মাণের আগেনদীর মূল প্রবাহ প্রধানত কুলাগাঁও অভিমুখে বাম তীর ঘেষেইপ্রবাহিত হত।কালুরঘাট সেতু হওয়ার পর সেতুর ডান দিকে আরও একটি প্রবাহের মুখতৈরি হয়।ফলে নদীর মাঝ পথে সৃষ্টি হয় বিশাল একটি চর- যা কুলাগাঁও চর নামেপরিচিত।
কাপ্তাই বাঁধ
কর্ণফুলীনদীর উপর বাঁধ দিয়েরাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায়কাপ্তাই বাঁধতৈরি করাহয় ১৯৬৪ খ্রীস্টাব্দে। এই বাঁধে সঞ্চিত পানি ব্যবহার করেকাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রেবিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়।
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে প্রভাব
কবিওহীদুল আলম১৯৪৬ সালেকর্ণফুলীর মাঝিনামে একটি কাহিনী-কাব্য রচনা করেন। ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবিআলাউদ্দিন আল আজাদ১৯৬২ সালে রচনা করেন তার উপন্যাসকর্ণফুলী। জাতীয় কবিকাজী নজরুল ইসলামতার কবিতায় লিখেছেন,
“ | ওগো ও কর্ণফুলী তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি | ” |
এছাড়াও চট্টগ্রামী ভাষার গানে এবং লোক-সংস্কৃতিতে এই নদীর প্রভাব অনেক। চট্টগ্রামী ভাষার ক’টি জনপ্রিয় গান,
১. ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানিত ছোড ছোড ঢেউ তুলি
লুসাই ফা-রত্তুন লামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী’।
২. ‘ওরে সাম্পানওয়ালা,
তুই আমারে করলি দিওয়ানা’।
২। হালদা নদী
হালদাবাংলাদেশেরদক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি নদী।পার্বত্য চট্টগ্রামেরবাটনাতলীপাহাড় হতে উৎপন্ন হয়ে এটিফটিকছড়িরমধ্য দিয়েচট্টগ্রাম জেলায় প্রবেশকরেছে। এটি এর পর দক্ষিণ-পশ্চিমে ও পরে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েফটিকছড়িরবিবিরহাট, নাজিরহাট, সাত্তারঘাট, ও অন্যান্য অংশ, হাটহাজারী, রাউজান, এবং চট্টগ্রাম শহরেরকোতোয়ালী থানার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এটিকালুরঘাটেরনিকটেকর্ণফুলীনদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এর মোট দৈর্ঘ্য ৮১ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২৯কিলোমিটার অংশ সারা বছর বড় নৌকা চলাচলের উপযোগী থাকে।
নামকরণ
হালদা খালের উৎপত্তি স্থলমানিকছড়ি উপজেলারবাটনাতলী ইউনিয়নেরপাহাড়ী গ্রাম সালদা। সালদার পাহাড়ী র্ঝণা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদা থেকেহালদা নামকরণ হয়।সালদা নামে বাংলাদেশে আরো একটি নদী আছে যেটি ভারতেরত্রিপুরা রাজ্য থেকে উৎপন্ন ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিতহয়েছে।
উপনদী
হালদা নদীতে পতিত দুপাশেরউপনদীগুলো প্রশস্ততার বিচারে সাধারণত নদীর পর্য্যায়ে পড়েনা। বেশিরভাগছড়া, খাল কিংবা ঝর্ণা জাতীয়।তবে মানিকছড়ি, ধুরুং এবং সর্তা যথেষ্টপ্রশস্ত। পূর্বদিক হতে যেসব খাল হালদার সাথে মিলিত হয়েছে তারউৎপত্তিপার্বত্য চট্টগ্রামেরপাহাড়ে। পশ্চিম দিক হতে আসা খাল গুলোর উতপত্তিস্থলসীতাকুন্ড পাহাড়।দুই পাহাড়ের মাঝখানে হালদা নদী প্রবাহিত হয়েছেউত্তর দিক হতে দক্ষিণদিকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় থেকে উৎপন্ন খালগুলো হচ্ছে মানিকছড়ি, ধুরুং, তেলপারই, সর্তা, কাগতিয়া এবং ডোমখালী খাল।সীতাকুন্ড পাহাড়ী রেঞ্জহতে উৎপন্ন হওয়া খালগুলোর মাঝে আছেগজারিয়া,ফটিকছড়ি,হারুয়ালছড়ি, বারমাসিয়া, মন্দাকিনী, বোয়ালিয়া এবংপোড়া কপালী খাল।
মাছের ডিম ছাড়া
প্রতিবছরহালদা নদীতে একটি বিশেষ মূহুর্তে ও বিশেষ পরিবেশেরুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউসওকার্পজাতীয় মাতৃমাছ প্রচুর পরিমাণ ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার বিশেষসময়কে তিথি বলা হয়ে থাকে। স্থানীয়জেলেরাডিম ছাড়ার তিথির পূর্বেই নদীতে অবস্থান নেন এবং ডিম সংগ্রহ করেন।ডিমসংগ্রহ করে তারা বিভিন্ন বাণিজ্যিক হ্যাচারীতে উচ্চমূল্যে বিক্রী করেন।
হালদা নদীতেরুইজাতীয় মাছের ডিম ছাড়ার কারণ
হালদানদী এবং নদীর পানির কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য এখানে মাছ ডিম ছাড়তে আসেযাবাংলাদেশেরঅন্যান্য নদী থেকে ভিন্ন তর । এই বৈশিষ্ট্যগুলোভৌতিক, রাসায়নিকওজৈবিক।ভৌতিক কারন গুলোর মধ্যে রয়েছে নদীর বাঁক , অনেকগুলোনিপাতিত পাহাড়ীঝর্ণা বা ছড়া , প্রতিটি পতিত ছড়ার উজানে এক বা একাধিক বিল, নদীর গভীরতা , কম তাপমাত্রা , তীব্র খরস্রোত এবং অতি ঘোলাত্ব ।রাসায়নিক কারণ গুলোরমধ্যে রয়েছে কম কন্ডাক্টিভিটি , সহনশীলদ্রবীভুতঅক্সিজেন। জৈবিক কারণ গুলো হচ্ছে বর্ষার সময় প্রথম বর্ষণের পর বিলথাকার কারণেএবং দুকুলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়ে নদীর পানিতে প্রচুরজৈব উপাদানেরমিশ্রণের ফলে পর্যাপ্ত খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে যা প্রজনন পূর্বগোনাডেরপরিপক্কতায় সাহায্য করে। অনেক গুলো পাহাড়ী ঝর্ণা বিধৌত পানিতেপ্রচুরম্যেক্রো ও মাইক্রো পুষ্টি উপাদান থাকার ফলে নদীতে পর্যাপ্ত খাদ্যাণুরসৃষ্টি হয় , এই সব বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে হালদা নদীতে অনুকুলপরিবেশসৃষ্টির মাধ্যমে রুই জাতীয় মাছকে বর্ষাকালে ডিম ছাড়তে উদ্ভুদ্ধ করেযবাংলাদেশের অন্যান্য নদী থেকে আলাদা
সাঙ্গু নদী
সাঙ্গু নদী, স্থানীয়ভাবেশঙ্খ নদী, বাংলাদেশেরদক্ষিণেপার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলেঅবস্থিত একটি পাহাড়িনদী।কর্নফুলীর পর এটি চট্টগ্রাম বিভাগের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী।বাংলাদেশেরঅভ্যন্তরে যে কয়টি নদীর উৎপত্তি তার মধ্যে সাঙ্গু নদীঅন্যতম।মিয়ানমারসীমান্তবর্তী বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার মদক এলাকারপাহাড়ে এ নদীর জন্ম।বান্দরবান জেলা ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের ওপর দিয়েপ্রবাহিত হয়ে এটিবঙ্গোপসাগরে গিযে মিশেছে।উৎসমুখ হতেবঙ্গোপসাগরপর্যন্ত এইনদীর দৈর্ঘ্য ১৭০ কিলোমিটার।
সাঙ্গু নদী বান্দবান জেলার প্রধানতমনদী। বান্দরবান জেলা শহরও এ নদীরতীরে অবস্থিত। এ জেলার জীবন–জীবিকার সাথেসাঙ্গু নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত।বান্দরবানের পাহাড়ি জনপদের যোগাযোগেরক্ষেত্রে এ নদী একটি অন্যতম মাধ্যম।
বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশেরপ্রধান কয়েকটি পাহাড়ি নদীর মধ্যে সাঙ্গু নদী অন্যতম।বান্দরবান জেলা এবংচট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল এ নদীবিধৌত। বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদী উত্তর হতেদক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে।কিন্তু সাঙ্গু নদীবান্দরবানের দক্ষিণাঞ্চলে সৃষ্টি হয়ে উত্তর দিকেপ্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরেগিয়ে শেষ হয়েছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস