বাংলাদেশের জেলা প্রশাসন
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্থানের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই জেলা প্রশাসন সরকারের একটি গুরত্বপূর্ণ ইউনিট হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা পালন করে আসছে। জেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক বা ডেপুটি কমিশনার হিসাবে পরিচিত। তিনি প্রশাসন, পরিকল্পনা, উন্নয়ন এবং সরকারি নিয়ম পদ্ধতির সমন্বয়কারী এবং প্রশাসন কাডারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ডেপুটি কমিশনার হিসাবে জেলায় পোস্টিং পাওয়ার আগে তিনি সহকারী কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার পদে এবং সচিবালয়ে সহকারী সচিব ও উপসচিব পদে দায়িত্ব পালন করেন। আজকের যে জেলা প্রশাসন বাংলাদেশে দেখতে পাই তার বিকাশ লাভ করেছিল বৃটিশ আমলে। বৃটিশ আমলের পর পাকিস্থান আমলেও জেলা প্রশাসন বিভিন্ন পরিবর্তনের ধারায় অগ্রসর হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর আজ পর্যন্ত সেই পরিবর্তন অব্যাহত রয়েছে।
বৃটিশ আমলে জেলা প্রশাসনের ক্রমবিকাশ
জেলা প্রশাসনের ধারণা প্রথম লক্ষ্য করা যায় এই উপমহাদেশে মুঘল শাসনামলে। মুঘল শাসনামলে ভারতকে বহু সুবায় (প্রদেশে) বিভক্ত করা হয়। মুঘল শাসকেরা বাংলা অধিকার করার পর বাংলাকে প্রদেশের মর্যাদা দেন; বাংলাকে সুবে বাংলা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। আবার সুবে বাংলাকে কতিপয় সরকার এবং পরগনায় ভাগ করা হয়। এই সরকার এবং পরগনাকে আজকের জেলা প্রশাসনের সাথে অনেকখানি তুলনা করা যায়। একজন সুবেদার বা গভর্নরের অধীনে ন্যস্ত সুবা বা প্রদেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনের স্তর হিসাবে গণ্য হত। পরগণার প্রশাসনে বিশেষ প্রাধান্য ছিল না। সাম্রাজ্য এভাবে বিভক্তির আসল উদ্দেশ্য ছিল রাজস্ব আদায়েরর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা।
বৃটেনের ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি এই উপমহাদেশে এসে বাণিজ্যের পাশাপাশি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে থাকে। তারই প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে এই কম্পানি ১৭৫৭ সালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজকে পরাজিত করে পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠিত করে। ১৭৬৫ সালে মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। কম্পানির কর্মকর্তারা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে মুঘলদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বহাল রাখে এবং আরও উন্নতি সাধন করে।
এই অঞ্চলে বৃটিশ শাসনের সময় ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলাকে ১৭৭২ সালে ২৩ টি জেলায় বিভক্ত করে প্রতি জেলায় একজন ইউরোপীয় কালেক্টর নিয়োগ দেন। প্রত্যেক জেলায় রাজস্ব সংগ্রহের জন্যে একজন স্থানীয় দেওয়ান কালেক্টরকে সাহায্য করতেন। একজন কাজী এবং মুফতি কালেক্টরকে ফৌজদারী বিচারের ক্ষেত্রে সাহায্য করতেন। অতএব বলা যায় একজন কালেক্টর একদিকে রাজস্ব প্রশাসন দেখতেন; অন্যদিকে ফৌজদারী বিচার করতেন। কালেক্টর এ দ্বিবিধ কর্তব্যের জন্য তিনি পৃথক পৃথক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অধীনে কাজ করতেন। যেমন- রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যাপারে রাজস্ব বোর্ডের অধীনে এবং বিচার বিভাগীয় কাজের জন্য তিনি কলকাতার সদর দেওয়ানী আদালতের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। গভর্ণর জেনারেলের সভাপতিত্বে সদর দেওয়ানী আদালত পরিচালিত হত। ছয়টি প্রাদেশিক আদালত গঠন করা হয়। তারা দেওয়ানদের কাজকর্ম পরিদর্শন এবং জেলা দেওয়ানী আদালতের শুনানী গ্রহণ করত।
হেস্টিংস পুলিশ বাহিনীকে জমিদারদের দ্বারা সংগঠিত করেন। পরবর্তী গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ পুলিশ বাহিনীকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং থানা প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রতি থানা একজন ইনস্পেক্টর এর দায়িত্বে ন্যস্ত করেন। ১৭৬৭ সালে একজন পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীকে কালেক্টরের পরিদর্শন ও কর্তৃত্বাধীনে আনা হয়।
১৭৮১ সালে আঠারো জন কালেক্টর নিয়োগ করা হয়। তাদের রাজস্ব আদায় ও ফৌজদারী আদালতসমূহের পরিদর্শনের দায়িত্ব দেয়া হয়। দেওয়ানী আদালতের স্বাধীন মর্যাদা প্রদান করে একজন ইউরোপীয় বিচারক নিয়োগ করা হয়।
এ পর্যায়ে জেলা প্রশাসন সম্পর্কে দু’ধরণের মতামত প্রাধান্য পেতে থাকে। কর্নওয়ালিশপন্থীরা প্রশাসনকে সংযত ও ভারসাম্যপূর্ণ রেখে ক্ষমতার বিভাজন’ এর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। তারা কালেক্টরের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত হওয়ার বিরুদ্ধে এবং ইংল্যান্ড হতে বৃটিশ কর্মকর্তা এনে ভারত শাসনের পক্ষপাতী। অপরদিকে মন্রোপন্থীরা একই হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত করে মুঘল পদ্ধতির প্রশাসন পরিচালনার প্রতি আগ্রহশীল হয়।
১৭৮৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরগণ কালেক্টরকে স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্ব দিয়ে তাকে একই সাথে কালেক্টর, দেওয়ানী জজ এবং ফৌজদারী আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে গণ্য করার জন্য সুপ্রিম কাউন্সিলের নিকট সুপারিশ পাঠায়। গভর্নর জেনারেল ম্যাকফারশন বাংলা প্রদেশকে ১৭৮৬ সালে ৩৬ টি জেলায় বিভক্ত এবং প্রতি জেলায় একজন কালেক্টর নিয়োগ করে। এ সময় দেশীয় দেওয়ান পদ বাতিল করা হয়।
১৭৯৩ সালে কালেক্টরকে ম্যাজিস্ট্রেট এর ক্ষমতা অর্পণ করা হয় এবং রাজস্ব আদায় ও আইন-শৃংখলার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। পরবর্তীকালে বিচার বিভাগকে প্রশাসন হতে আলাদা করে আদালতের অধীনে নেওয়া হয়। রাজস্ব বোর্ড অবলুপ্ত করে চারটি সার্কিট কোর্টে কালেক্টরের আদেশের বিরুদ্ধে আপীল শুনানীর ব্যবস্থা করা হয়। ১৮২৯ সালে সার্কিট কোর্টের পরিবর্তে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় স্থাপন করা হয় এবং ১৮৩১ সাল পর্যন্ত দেওয়ানী, ফৌজদারী ও রাজস্ব আপীলসমূহের শুনানী এখানে গৃহীত হয়।
১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি হতে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করার পর ব্রিটিশরাজ ভূমিরাজস্ব ও প্রজাস্বত্ব আইন, দণ্ডাদেশ ও ফৌজদারী কার্যবিধি জারী করে। এরফলে কালেক্টরের নির্বাহী ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কিছু ক্ষুন্ন হয়। তিনি শুধু আইন শৃঙ্খলা ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকেন।
১৮৬১ সালে কালেক্টরকে ফৌজদারী মোকদ্দমা নিষ্পত্তির দায়িত্ব প্রদান করে তাকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদবী দেওয়া হয়। জেলা জজকে কোর্ট অব সেশন্স/দায়রা আদালত করা হয়। কলকাতার সদর দেওয়ানী আদালত আপীল আদালতে পরিণত হয়। কমিশনার রাজস্ব মোকদ্দমার আপীল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পায়।
ক্রমান্বয়ে জনগণের কল্যাণে সরকারী কাজের পরিধি ও প্রকৃতি বিভিন্নভাবে বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন কাজের জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও বিশেষ পদ্ধতির প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়। সরকার অনেক নতুন বিভাগ ও শাখা সৃষ্টি করে। প্রত্যেক ডিপার্টমেন্ট জেলা পর্যায়ে একজন প্রতিনিধি বা কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করে।
১৮৭২ সালে বাংলার গভর্নর স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর পদকে আরও শক্তিশালী করে অনেক দায়িত্ব দেন। তিনি বিভাগীয় প্রধানকে সরকারের প্রতিনিধি ও পরিদর্শক হিসাবে তাদের অধঃস্তন কর্মকর্তাদের সাহায্য, পরামর্শ ও পরিচালনা করার জন্য নির্দেশ জারী করেন। কোনক্রমেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর উপর স্থানীয়ভাবে আধিপত্য না করার জন্য উপদেশ প্রদান করেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরকে জেলা পর্যায়ের সকল কর্মকর্তাদের সাধারণ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ করা হয়। এভাবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলার প্রধান নির্বাহী প্রশাসক পরিগণিত হন। প্রকৃতপক্ষে জেলা কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণ পুলিশ প্রশাসনেই সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যান্য জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ তাদের প্রাদেশিক সদর দফতরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরিদর্শন ও নিয়ন্ত্রণে চলতে থাকে।
ভারতবর্ষের প্রশাসন বিকেন্দ্রিকরণ রাজকীয় কমিশন(১৯০৭-১৯০৯) জেলা প্রশাসকের অবস্থান প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে জেলার অপর সকল বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মেনে নেওয়ার সুপারিশ করে। কমিশন জেলার অন্যান্য কর্মকর্তাদের উপর কালেক্টরের সুসংবদ্ধ প্রভাব লক্ষ্য করে এবং সুপারিশ রাখে যে, অপর সকল বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ কালেক্টরের প্রয়োজনে সকল প্রকার সংবাদ ও তথ্যাদি প্রদান করবে। কোন গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের মতামতই প্রাধান্য পাবে।
১৯১৯ সালে মন্টেগু চেম্সফোর্ড প্রশাসনিক সংস্কারের পদক্ষেপ হিসেবে নির্বাচিত সদস্য সহযোগে বিচার বিভাগীয় কাউন্সিল প্রবর্তন করে। এটা ক্ষমতায়নের এক নতুন কাঠামো। এতে কালেক্টরের অবস্থানকে অনেকভাবে প্রভাবিত করে। এ পর্যন্ত সরকার কালেক্টরের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে মত বিনিময় করতো এবং তার উপদেশ গৃহীত হত। কিন্তু বিচার বিভাগীয় কাউন্সিল হওয়ার পর কালেক্টরের কার্যাবলী প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। বিভিন্ন সভায় কালেক্টরকে জবাবদিহি করতে হয়। নির্বাচিত সদস্যদের উপদেশ এতে গুরত্ব পায়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রভাব ও উদ্যোগ এতে কমতে থাকে। যদিও তিনি জেলার রাজস্ব আদায় করেন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাসহ পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেন। তাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শ্রেণী সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মোকাবিলা করতে হয়। তার অন্যতম দায়িত্ব ছিল জেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিদর্শন করে তার মতামতসহ মন্ত্রণালয়ে পেশ করা। এ সময়ের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হল যে কালেক্টর প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কর্মীদের সহযোগিতায় কাজ করতে বাধ্য হন।
সাইমন কমিশন (১৯৩০) ধারণা পোষণ করে যে কালেক্টরকে অবশ্যই কার্যকর ক্ষমতার প্রতিভূ হতে হবে। যার উপর দেশের দুর্যোগ ও দুর্দিনের সময়ে সম্পদ সংরক্ষণের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকবে। কমিশন সুপারিশ করে যে কালেক্টর জেলার সকল প্রকৌশল বিভাগ ও পুলিশ প্রধানেরও প্রধান হবেন।
পাকিস্থান আমলে জেলা প্রশাসন
১৯৪৭ সালে গ্রেট বৃটেন ভারতীয় উপামহাদেশকে স্বাধীনতা দেয়; এরফলে পাকিস্থান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্টের সৃষ্টি হয়। পাকিস্থান আমলে জেলা প্রশাসন সরকারের একটি শক্তিশালী ইউনিট হিসাবে দেখা যায়। পাকিস্থানের দুটি ইউনিট ছিল-পশ্চিম পাকিস্থান এবং পূর্ব পাকিস্থান (বর্তমান বাংলাদেশ)। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে প্রশাসনিক ইউনিটটি ছিল নিম্নরূপ-
পূর্ব পাকিস্থান |
বিভাগ-৪ |
জেলা-১৯ |
মহকুমা-৬৩ |
থানা-৪৮৭ |
শহর ও নগর |
পৌরসভা-৭৯
ইউনিয়ন পরিষদ-৪,৩৫২
গ্রাম-৬৪,৪৯৩ |
পূর্ব পাকিস্তানকে ৪টি বিভাগে ভাগ করা হয়; এই চারটি বিভাগ হল-ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহী বিভাগ। আবার চারটি বিভাগকে ১৯টি জেলায় বিভক্ত করা হয়। জেলা কতিপয় মহাকুমায় বিভক্ত ছিল। প্রতি মহাকুমায় একজন মহাকুমা কর্মকর্তা (এস,ডি,ও) নিয়োজিত ছিল। তিনি নিম্ন বেতনক্রমের কর্মকর্তা হলেও, তার কার্যকারিতা ব্যাপক ছিল। তিনি সরাসরি জনগণের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। জেলা প্রশাসকের মতো প্রায় সকল ক্ষমতা তিনি ব্যবহার করতেন এবং থানা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ছিলেন।
১৯৬২ সালে থানা পরিষদ গঠনের আগ পর্যন্ত মহকুমা সর্বনিম্ন পর্যায়ের স্থানীয় প্রশাসনিক ইউনিট ছিল। মহকুমা সদরে সকল সরকারী বিভাগের কর্মকর্তা ছিল। দূরদুরান্ত থেকে সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন সমস্যা সমাধান ও মোকাদ্দমার জন্য মহকুমা শহরে যেতে হত।
জেলার আয়তন ও লোকসংখ্যার তারতম্যের জন্য মহকুমার সংখ্যা বিভিন্ন ছিল। টাঙ্গাইল জেলায় মাত্র একটি মহকুমা কিন্তু ময়মনসিংহ জেলায় পাঁচটি মহকুমা ছিল। রাজশাহী, রংপুর, যশোর, ফরিদপুর, সিলেট এবং কুমিল্লা জেলার প্রত্যেকটিতে ৪টি মহকুমা ছিল। মহকুমার আয়তন ও লোকসংখ্যাও বিভিন্ন প্রকার ছিল।
পাকিস্থান আমলে কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস (সি,এস,পি) অফিসার দুই বছর দেশে ও বিদেশে কঠিন প্রশিক্ষণের পর মহকুমা অফিসার পদে নিযুক্ত হত। তাদের অভিজ্ঞতা কম ছিল। কিন্তু উতসাহ, উদ্দীপনা, প্রশিক্ষণের জ্ঞান এবং দেশ গড়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক গুরত্বপূর্ণ প্রকল্প স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে বাস্তবায়ন করতো।
অল্প বয়সী ও উদ্যেগী এস,ডি,ও তার এলাকায় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ কল্যাণমূলক পরিকল্পনার কাজ বাস্তবায়ন করেন। সে সময় সরকারি তহবিল যথেষ্ট না থাকার জন্য, তার নেতৃত্বে বেসরকারি চাঁদা সংগ্রহ করে স্কুল, কলেজ, স্টেডিয়াম, পাবলিক লাইব্রেরি, ক্রীড়া সংস্থা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা হত। তিনি স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সহায়তায় সমস্যাবলী সমাধানের জন্য মধ্যস্থতা করতেন। জরুরি অবস্থায় স্থানীয় চাহিদা পুরুণের এবং সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। তিনি ডেপুটি কমিশনার ও সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ করতেন। থানা পরিদর্শন, পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট কনফারেন্স, রাজস্ব আদায় ও মহকুমা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় সভাপতিত্ব তার দায়িত্ব ছিল।
১৯৬২ সালে থানা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হবার আগে মহকুমা প্রশাসন সরকারের সর্বনিম্ন ধাপ হিসেবে পরিচিত ছিল। মহাকুমায় সরকারের সকল বিভাগের কর্মকর্তারা প্রতিনিধিত্ব করতেন। দূরদুরান্ত হতে জনসাধারণ তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য মহকুমা শহরে বিভিন্ন কার্যালয়ে আগমন করতো। মুন্সেফ ও ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত, হাসপাতাল, শিক্ষা অফিস ইত্যাদি এখানে অবস্থিত ছিল। সাবট্রেজারী, সাবজেল, রিলিফ ও রাজস্ব মহকুমা শহরে ছিল।
প্রত্যেক মহকুমা কয়েকটি থানায় বিভক্ত ছিল। মহকুমায় দুই থেকে দশ-বারোটি থানা ছিল। একটি থানা একশত থেকে দেড়শত বর্গমাইল বিস্তৃত। পূর্ব পাকিস্থানে ৪৮৭টি থানা ছিল। থানার লোকসংখ্যা এক লক্ষ থেকে তিন লক্ষ পর্যন্ত ছিল। পুলিশ প্রশাসনের জন্যই থানা সৃষ্টি হয়েছিল।
১৯৬২ সালে উন্নয়ন প্রশাসনকে থানা পর্যায় পর্যন্ত সরকারিভাবে বিকেন্দ্রিকরণের নীতি গৃহীত হয়। প্রতি থানায় একজন গেজেটেড কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। তাদের পদবী ছিল সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন)। থানা পর্যায়ে অন্যান্য জাতিগঠনমূলক বিভাগ তাদের কর্মকর্তা নিয়োগ সকল থানা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একত্রে বসানোর জন্য একটি থানা সচিবালয় নির্মাণ করা হয়। এই ব্যবস্থার মুল উদ্দেশ্য ছিল সকলে একই ছাদের নিচে বসে আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় ও সহযোগিতার মাধ্যমে জনসাধারণের সমস্যা সমাধানের জন্য সুচারুভাবে কাজ করবে। কর্মকর্তাদের বাসস্থানের জন্য দালান তৈরি করা হয়। থানা সদরে পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্র তৈরি করা হয়। স্থানীয় জনগণ এ উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সাড়া দেয়। তারা থানা সদরে উচ্চ শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্কুল ও কলেজ স্থাপন করে। প্রতি থানায় উপশহর গড়ে উঠে। সাধারণ কাজের জন্য মহাকুমায় না যেয়ে প্রায় সকল সমস্যা থানা সচিবালয়ে নিষ্পন্ন করতে পারে। এভাবে প্রশাসন বিকেন্দ্রিকরণ সম্পন্ন হয়। জনগণের বহু দিনের দুর্ভোগের অবসান হয়। জনসাধারণ ও সরকারি কর্মচারিদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সৌহার্দ বৃদ্ধি পায়। এরফলে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হতে থাকে।
ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও থানা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত হয় থানা পরিষদ। এই পরিষদে সরকারি কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি একত্রিত হন। পল্লী উন্নয়নের সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মহাকুমা কর্মকর্তা এ সভায় সভাপতিত্ব করতেন। সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) পরিষদের সহ-সভাপতি হিসাবে নথিপত্র সংরক্ষণের দায়িত্ব পান।
প্রতি থানা কয়েকটি ইউনিয়নে বিভক্ত ছিল। সাধারণত দশ থেকে কুড়িটি ইউনিয়ন নিয়ে একটি থানা গঠিত। প্রতি ইউনিয়নে একজন চেয়ারম্যান এবং নয় জন নির্বাচিত সদস্য নিয়ে একটি পরিষদ ছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর জেলা প্রশাসন
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরে ১৯৭২ সালে অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রশাসনিক এবং চাকরি পুনর্বিন্যাস কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি বিভাগ উঠিয়ে মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করার সুপারিশ করে। এতে আরও সুপারিশ করা হয় যে, কমিশনার পদটি পরিদর্শনকারী হিসেবে ব্যবহার করে তার উপর আঞ্চলিক পরিকল্পনার দায়িত্ব ন্যস্ত করা যেতে পারে। কমিটি প্রশাসন হতে বিচার বিভাগকে পৃথক করার জন্য সুপারিশ করে। তাদের মতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য ম্যাজিস্ট্রেট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করবে। এই কমিটি সুপারিশ করে যে, ডেপুটি কমিশনার পদটি রাজস্ব, পুলিশ প্রশাসন, নিয়মতান্ত্রিক কার্যাবলি, পারমিট ও লাইসেন্স প্রদান, থানা, ইউনিয়ন, মালখানা ও জেল পরিদর্শন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য কাজের জন্য অব্যাহত রাখা উচিত। কমিটি আরও সুপারিশ করে যে, নির্বাচিত জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা এবং সকল উন্নয়ন কার্যক্রম জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা যেতে পারে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অফিস জেলা পরিষদের অধীনে আসবে। এই কমিটি থানা পর্যায়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব নির্বাচিত থানা পরিষদের এখতিয়ারে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করে। এই সুপারিশমালা ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে সরকারের নিকট দাখিল করা হয়। কিন্তু উহা কার্যকর হয়নি।
১৯৭৬ সালে জিয়া সরকারের আমলে বেতন ও চাকরি কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিটি জেলা প্রশাসন পুনর্গঠন সম্পর্কে কোন সুপারিশ না করলেও, এ সময়ে জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের বেতন পুনর্বিন্যাস করে। সাইফুর রহমানের সভাপতিত্বে বেতন কমিটি জেলার টেকনিক্যাল কর্মকর্তা ও বিচারকের বেতন বাড়িয়ে দেয় এবং আনুপাতিকভাবে জেলার ডেপুটি কমিশনার, ম্যাজিস্ট্রেট এবং প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তাদের বেতন অনেক কমে যায়। এজন্য জেলা প্রশাসনে অনেক অসন্তোষ দেখা দেয়। ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কমিশনার অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তা কালোব্যাজ পরা শুরু করে। এই নীতির ফলে জনসাধারণের মধ্য সরকারের নীতির বিরুদ্ধে বিরূপ সমালোচনা শুরু হয়। তথ্য মন্ত্রণালয় এই অবস্থা রাষ্ট্রপতির গোচরীভূত করায় সেনাভবনে এক সভা ডাকা হয়। এই সভায় দীর্ঘ আলোচনার পরে কমিটির চেয়ারম্যানকে সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়।
এরশাদ শাসনামলে ১৯৮২ সালে প্রশাসন পুনর্বিন্যাস ও কমিশন গঠিত হয়। এই কমিটির সুপারিশ অনুসারে প্রশাসনে অনেক গুরত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়। প্রথম পর্যায়ে থানায় নির্বাচিত চেয়ারম্যানের অধীনে উপজেলা পদ্ধতি চালু হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। এ সময় ৪৪টি নতুন জেলাসহ সারাদেশে মোট ৬৪টি জেলা হয়।
খালেদা জিয়ার শাসনামলে ১৯৯২ সালে উপজেলা বিলুপ্ত হয়। এ সময় আরেকটি প্রশাসন পুনর্গঠন কমিটি গঠিত ও নিযুক্ত হয়। এই কমিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কমানো, পরিকল্পনা কমিশন ছোট করা, বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ করা, হিসাব ও অডিট বিভাগ পৃথকীকরণ ইত্যাদি সুপারিশ করে। এছাড়া তথ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে উপজেলার বিকল্প পদ্ধতি সম্পর্কে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি অনেক সেমিনার, সভা ও আলোচনার পরে উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচিত চেয়ারম্যান পদ্ধতি পুনরায় চালু করার সুপারিশ করে। কিন্তু তৎকালীন সরকার এই ২ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি। এই সময় রাজনৈতিক কারণে বরিশাল ও সিলেটে বিভাগ সৃষ্টি করা হয়।
শেখ হাসিনার শাসনামলে ১৯৯৬ সালে প্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। শামসুল হক-এর সভাপতিত্বে এই কমিটি ৪ বছর বহু সেমিনার, পরীক্ষা ও নিরীক্ষার পরে অনেকগুলি রিপোর্ট দিয়েছে। কিন্তু এসব রিপোর্টের কোন বাস্তবায়ন হয়নি। এ সময় উপজেলা ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার উপর জোর দেওয়া হলেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি, অন্যদিকে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ করাও হয়নি।
২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর প্রশাসনে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার জন্য দেশের সুশীল সমাজ তাদের যৌক্তিক দাবি সরকারের কাছে উপস্থাপন করে। এই সরকার জনগণের দীর্ঘদিনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয় ১নভেম্বর, ২০০৭ বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করার মধ্য দিয়ে। এরফলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচার করার প্রকৃত ক্ষমতা হারায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি উপজেলা নির্বাচনের আয়োজন করে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে জনগণের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নকে পূরণ করে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন
বাংলাদেশে বর্তমান সাতটি বিভাগ আছে; এই সাতটি বিভাগ হল-ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও রংপুর। চট্টগ্রাম বিভাগে ১১টি জেলা রয়েছে; তারমধ্যে চট্টগ্রাম জেলা ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অন্যতম একটি জেলা। প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়ের কারণে প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রাম বাণিজ্যের জন্য একটি গুরত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল; আরব সভ্যতার স্বর্ণযুগে নবম শতকে আরবীয় মুসলমান ব্যবসায়ীদেরকে চট্টগ্রাম ব্যাপকভাবে আকর্ষণ করে। এরপর জানা যায় ষোল এবং সতের শতকে এই অঞ্চল আরাকান রাজার শাসনাধীনে আসে; কিন্তু পরে ইসলাম খানের নেতৃত্বে মুঘল সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম জয় করে। সতের শতকে এই অঞ্চল প্রায়ই পূর্তগীজ দস্যুরা আক্রমন করত এবং লুন্ঠন করত। ১৬৬৬ সালে মুঘলরা চট্টগ্রামকে বাংলা প্রদেশের একটি সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এরপর ১৭৬৫ সালে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করলে চট্টগ্রাম এই কম্পানির শাসনাধীনে চলে আসে। ১৭৭২ সালে হেস্টিংস বাংলা প্রদেশকে ২৩টি জেলায় বিভক্ত করেন। চট্টগ্রাম এই ২৩টি জেলার একটি জেলা ছিল। তখন জেলা কালেক্টর হিসেবে প্রথম চট্টগ্রাম জেলার দায়িত্ব পান মিস্টার বেন্টলে; বৃটিশ আমলে চট্টগ্রামের সর্বশেষ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন ভারতীয় সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা এফ,এ, করিম। ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে চট্টগ্রাম জেলা থেকে পৃথক করে আলাদা প্রশাসনিক ইউনিট করে একজন ডেপুটি কমিশনারকে ঐ অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৮৪ সালে কক্সবাজারকে চট্টগ্রাম থেকে পৃথক করে একটি জেলা করা হয়।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS